দক্ষিনবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: দীর্ঘ বিতর্কপর্বের পর বুধবার গভীর রাতে লোকসভায় পাশ হল সংশোধিত ওয়াকফ বিল। বিলের পক্ষে ২৮৮ এবং বিপক্ষে ২৩২ জন সাংসদ ভোট দিলেন। তবে বড় কোনও অশান্তি হল না অধিবেশনে। বৃহস্পতিবার বিল পেশ হবে রাজ্যসভায়।
বুধবার লোকসভায় বিল পেশের আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় সরকারের অবস্থানের কথা জানান। এর পরে কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু ‘ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৫’ পেশ করেন । বিল পেশের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়। তাঁর অভিযোগ, জেপিসিতে ভিন্নমত প্রকাশ করে বিরোধী সাংসদদের দেওয়া নোটগুলি উপেক্ষা করা হয়েছে বিলে।
বিরোধীরা বিল নিয়ে ভুল তথ্য এবং গুজব ছড়াচ্ছেন বলে বুধবার লোকসভায় অভিযোগ করেন রিজিজু। বিলের সমালোচনা যাঁরা করছেন, তাঁদের নিশানা করে রিজিজু বলেন, “যখন আমরা কোনও ইতিবাচক সংস্কার আনছি, তখন কেন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে?” আলোচনা এবং সকলের মতামত নেওয়ার জন্য যৌথ সংসদীয় কমিটি বা জেপিসিকে ধন্যবাদ জানান রিজিজু। তিনি বলেন, “আমি জেপিসির সব সদস্যকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। ২৮৪টি প্রতিনিধিদল, ২৫টি রাজ্য, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং ওয়াকফ বোর্ড এই বিষয়ে জেপিসির কাছে নিজেদের মতামত জানিয়েছে।”
উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ যাদব অভিযোগ করেন মেরুকরণের উদ্দেশ্যেই সংশোধিত ওয়াকফ বিল এনেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। এ প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য, ‘‘বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী, উপমুখ্যমন্ত্রী আগে ইদের উৎসবে যোগ দিতেন। হঠাৎ কী হল জানি না। আমাদের সংবিধান কি এই শিক্ষা দেয়!’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘যখনই বিজেপি কোনও বিল আনে নিজেদের ব্যর্থতা চাপা দেওয়ার জন্য আনে।’’ সেই ‘ব্যর্থতা’র উদাহরণ প্রসঙ্গে অখিলেশ বুধবার মোদী সরকারের নোটবন্দির প্রসঙ্গও তুললেন। তাঁর দাবি, একের পর এক ব্যর্থতা দিয়ে এই বিল তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে তাঁর খোঁচা, বিজেপি শুধু একটি পুরনো ঘটনার কথাই ভাবে, অযোধ্যার কথা। অসমের কংগ্রেস সাংসদ গৌরব গগৈও ওয়াকফ বিল নিয়ে শাসক শিবিরের বিরুদ্ধে মেরুকরণের অভিযোগ তোলেন। তাঁর মন্তব্য, “এই বিল সংবিধানকে অবজ্ঞা করতে চায়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে অপদস্থ করতে চায় এবং ভারতের সমাজকে বিভক্ত করতে চায়।” সেই সঙ্গে রিজিজুকে নিশানা করে তাঁর তোপ— ‘‘সংসদকে বিভ্রান্ত করছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী।’’
ওয়াকফ বিল নিয়ে জেপিসিতে বিতণ্ডার সময় উত্তেজনার মুহূর্তে কাচের বোতল ভেঙে আহত হয়েছিলেন তিনি। শ্রীরামপুরের তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবারের বিতর্কে অংশ নিয়ে ওয়াকফ বিলকে সরাসরি ‘অসাংবিধানিক’ বললেন। তাঁর মন্তব্য, ‘‘আমি এই বিলকে একেবারেই সমর্থন করছি না। এই বিল অসাংবিধানিক। তৃণমূলের তরফে আমরা এই বিলের বিরোধিতা করছি।’’ তাঁর অভিযোগ, বিজেপির আনা এই বিলে মুসলমানদের অধিকার খর্ব হচ্ছে। ওয়াকফ বিলের নেপথ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। কল্যাণ বলেন, ‘‘ওয়াকফ সংশোধনী বিলের আড়ালে কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন সম্প্রদায়কে ভাগ করতে চাইছে। যদি ওরা একতাই চায়, তা হলে বিলে কেন ভাগের চেষ্টার কথা? সম্প্রদায়ের উপর ভিত্তি করে ওয়াকফ বোর্ডের মধ্যে শ্রেণিবিভাগ শাসকদলের খারাপ উদ্দেশ্যই ইঙ্গিত করে।
নরেন্দ্র মোদী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন গোধরা পরবর্তী গুজরাত দাঙ্গার জন্য তাঁকে দায়ী করে এনডিএ ছেড়েছিলেন লোক জনশক্তি পার্টির প্রধান রামবিলাস পাসোয়ান। মুসলিমদের প্রতি বৈষম্যের অভিযোগ তুলে ইস্তফা দিয়েছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভা থেকে। বিহারের প্রয়াত দলিত নেতার পুত্র চিরাগ কিন্তু বুধবার ওয়াকফ বিল নিয়ে মোদী সরকারের পাশেই দাঁড়ালেন। মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত ওয়াকফ বিল নিয়ে অবস্থান ধোঁয়াশায় রাখার পরেও শেষ পর্যন্ত বিজেপির পাশে দাঁড়িয়েছে আরও দুই শরিক, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের জেডিইউ এবং অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডুর টিডিপি। জেডিইউর লল্লন সিংহ এবং টিটিপির কৃষ্ণপ্রসাদ তেন্নেতি বুধবার বিতর্কে অংশ নিয়ে দাবি করেন, পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের কল্যাণে সহায়ক হবে সংশোধিত ওয়াকফ বিল।
কংগ্রেস, তৃণমূল, সমাজবাদী পার্টি, এনসিপি (শরদ), ডিএমকে, আরজেডির পাশাপাশি বুধবার লোকসভায় সংশোধিত ওয়াকফ বিলের বিরোধিতা করেছে ‘একদা হিন্দুত্ববাদী’ উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা (ইউবিটি)। উদ্ধবসেনার সাংসদ অরবিন্দ সাবন্ত ওয়াকফ বোর্ডে দুই অমুসলিম সদস্য এবং ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালে সিইও পদে আমলা নিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ‘‘সরকার কি মন্দির কমিটিতে অহিন্দুদের থাকার অনুমতি দেবে? কারণ তারা ওয়াকফ বোর্ডের কমিটিতে অমুসলিমদের স্থান দেওয়ার চেষ্টা করছে?’’
পাশাপাশি অরবিন্দের দাবি, জেপিসিতে প্রতিটি বিষয় ধরে ধরে আলোচনা হয়নি। বস্তুত, মঙ্গলবার সন্ধ্যার বৈঠকের সিদ্ধান্ত মেনেই ঐক্যবদ্ধ ভাবে লোকসভায় বিলের বিরোধিতা করেছে ‘ইন্ডিয়া’। যদিও ওয়েলে নেমে স্লোগান বা হট্টগোলের পথে না হেঁটে বিতর্কে অংশ নিয়ে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন তাঁরা যুক্তি এবং তথ্যের ভিত্তিতে নিশানা করেছেন সরকার পক্ষকে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ‘ইন্ডিয়া’ বহির্ভূত বিরোধী দল ‘আজাদ সমাজ পার্টি’র প্রধান তথা উত্তরপ্রদেশের নাগিনা কেন্দ্রের দলিত সাংসদ চন্দ্রশেখর আজাদ ওরফে রাবণও সংশোধিত ওয়াকফ বিলের বিরোধিতা করে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সামাজিক বিভাজনের অভিযোগ তোলেন।